কোনো কোনো ঘড়ির দিকে তাকালে দেখা যায় ঘড়ির ডায়ালের চারপাশে ঘন্টা-মিনিটের দাগ ছাড়াও আরও কিছু দাগ কাটা। সাথে আবার কিছু সংখ্যাও লেখা। কেউ কেউ হয়ত ভাবতেই পারেন ঘড়িটিকে একটু “কুল” দেখানোর জন্য অযথাই এই দাগ কিংবা নাম্বারগুলো বসিয়ে দেয়া হয়েছে। নাহ, এই দাগগুলো শুধু “কুল” দেখানোর জন্য বসানো হয় নি, এদেরও কাজ রয়েছে।

হরোলজি বা ঘড়িবিদ্যায় ঘড়ির কমপ্লিকেশন বা জটিলতা বলতে একটা ব্যাপার আছে। মূলত ঘড়িতে ব্যবহৃত এমন যে কোনো বৈশিষ্ট্য যা শুধুমাত্র ঘন্টা-মিনিট-সেকেন্ড পরিমাপের কাজেই ব্যবহৃত হয় না, বরং অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়, সেই সব বৈশিষ্ট্যকেই কমপ্লিকেশন বলা হয়।
এমন দু’টি কমপ্লিকেশন, যা আমরা রেসিং ওয়াচ কিংবা পাইলট ওয়াচে দেখি, তা হচ্ছে ক্রোনোগ্রাফ আর ট্যাকিমিটার। ঠিকঠাকভাবে এগুলো ব্যবহার করতে পারলে এগুলো মোটামুটি শক্তপোক্ত আর নির্ভরযোগ্য পরিমাপক যন্ত্রের কাজ করে। অতএব, ঘড়িতে থাকা এই দুটি বৈশিষ্ট্যকে কিভাবে কাজে লাগানো যায়, সেটা নিয়েই আমরা আলোচনা করবো।
ক্রোনোগ্রাফ
নাম শুনে ঘাবড়াবার কোনো কারণ নেই, সাধারণ স্টপওয়াচকেই একটু পালিশ করে ক্রোনোগ্রাফ নাম দিয়ে দেয়া হয়েছে, ক্রোনোগ্রাফ আর স্টপওয়াচের মধ্যে কোনোই পার্থক্য নেই। ঘড়ির সাথে সর্বপ্রথম ক্রোনোগ্রাফ লাগিয়ে দেয়া হয় বিংশ শতকের গোড়ায়, যাতে রেসিং কারের ড্রাইভার, কিংবা পাইলটরা সেটা ব্যবহার করতে পারে।
এমনকি এপোলো ১৩ মিশনের সময় আমেরিকান নভোচারী জ্যাক সুইজার্ট তাঁর ওমেগা স্পিডমাস্টার ঘড়িটির ক্রোনোগ্রাফ ব্যবহার করে মহাকাশযানের কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রের কোর্স সংশোধন করেছিলেন, যেজন্য মহাকাশযানটি নিরাপদে পৃথিবীতে পৌছাতে পেরেছিলো।

ক্রোনোগ্রাফ ব্যবহার করা খুবই সোজা ব্যাপার। স্টার্ট/স্টপ বোতামটি টিপে দিলেই ক্রোনোগ্রাফের সেকেন্ডের কাঁটাটি চলতে শুরু করবে আর চলা বন্ধ করবে, এটা যে কোনো বাচ্চাও বলে দিতে পারবে। তারপর নিচের দিকের বোতামটি টিপে দিলেই ক্রোনোগ্রাফের সেকেন্ডের কাঁটা আবারও রিসেট হয়ে যাবে, অর্থাৎ আগের জায়গায় ফিরে যাবে।
দোটানায় পড়তে হয় ঘড়ির প্রধান ডায়ালের মধ্যে থাকা সাব ডায়ালগুলো নিয়ে৷ যেমন, ওমেগা স্পিডমাস্টার ঘড়িতে তিনটি কাঁটা ও তিনটি সাবডায়াল আছে। কাঁটা তিনটি হলো, ক্রোনোগ্রাফের সেকেন্ডের কাঁটা, ঘড়ির মিনিটের কাঁটা, ঘড়ির ঘন্টার কাঁটা৷ সাব ডায়াল তিনটি হলো সেকেন্ডের সাব ডায়াল, ক্রোনোগ্রাফের মিনিটের সাব ডায়াল, ক্রোনোগ্রাফের ঘন্টার সাব ডায়াল।
ছবি- artofmanliness.com
ক্রোনোগ্রাফের সেকেন্ডের কাঁটাটি ঠিক সাধারণ সেকেন্ডের কাঁটার মত কাঁজ করে না। শুধুমাত্র স্টার্ট/স্টপ বোতাম টিপলেই এটি চলতে শুরু। আর ডান পাশে সাবডায়ালটি আছে, যেটির কাঁটা সবসময়ই ঘুরতে থাকে, সেই কাঁটাটিই আসলে সেকেন্ডের কাঁটা, আর ডায়ালটি সেকেন্ডের সাবডায়াল।
এছাড়া বাম পাশে আছে ক্রোনোগ্রাফের মিনিটের সাবডায়াল, দেখাই যাচ্ছে যে ত্রিশ মিনিট পর্যন্ত সময়ের রেকর্ড এতে রাখা যায়। নিচের দিকে আছে ক্রোনোগ্রাফের ঘন্টার সাবডায়াল। ক্রোনোগ্রাফ চালুর পর কত ঘন্টা অতিবাহিত হলো সেটি এই সাব ডায়ালে দেখা যায়৷
এই হলো হাতঘড়িতে থাকা ক্রোনোগ্রাফ ব্যবহার করে সময় পরিমাপের মোটামুটি নিয়ম।
ট্যাকিমিটার
এর হিসাব একটু জটিল। তবে ঠিকঠাক ব্যবহার করলে, আর হালকা পাতলা অংক কষে ফেলতে পারলে ট্যাকিমিটার দিয়ে অনেকগুলি কাজ করে নেয়া যায়। ধরুন আপনি গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছেন। তখন ট্যাকিমিটার দিয়ে আপনি গাড়ির গতিবেগ মেপে নিতে পারবেন। কিংবা গাড়িটি কতটুকু রাস্তা অতিক্রম করেছে তাও মেপে নিতে পারবেন। উন্নতমানের ট্যাকিমিটার হলে গাড়িতে ফুয়েল কতটুকু আছে তাও মাপতে পারবেন। হ্যাঁ, অবিশ্বাস্য ব্যাপারই বটে!

ট্যাকিমিটার হচ্ছে একরকমের স্কেল বা পরিমাপক, যা সাধারণত ঘড়ির ডায়ালের ফ্রেমে, কিংবা ডায়ালের ভেতরের দেয়ালে খোদাই করা বা আঁকা থাকে৷ এই স্কেল তৈরির সূত্র হচ্ছে-
ট্যাকিমিটার স্কেলের মান= ৩৬০০(এক ঘন্টায় যত সেকেন্ড হয়)/ অতিক্রান্ত সময়(সেকেন্ডে)
এই স্কেল দিয়ে অতিক্রান্ত সময়কে অতিক্রান্ত দূরত্বেও রূপান্তরিত করা যায়।
বেশিরভাগ ট্যাকিমিটারই কাজে লাগানোর উপযুক্ত হয় ঠিক ৭.২ সেকেন্ড অতিক্রান্ত হবার পরে। অর্থাৎ ৭.২ সেকেন্ডের কম সময়ের ভিত্তিতে পরিমাপ করতে গেলে ট্যাকিমিটারটি কোনো কাজেরই নয়, কারণ স্কেলের প্রথম মান ৫০০ দেয়া আছে ঠিক ৭.২ সেকেন্ডের পাশে।

তা, কিভাবে এই ট্যাকিমিটার দিয়ে কাজ করা হয়? আসুন দেখে নিই-
গতিবেগ মাপার জন্য ট্যাকিমিটারের ব্যবহার-
ট্যাকিমিটার দিয়ে কোনো বস্তুর গতিবেগ মাপার জন্য বস্তুর অতিক্রান্ত রাস্তার যেকোনো দুটি বিন্দুর মধ্যকার সঠিক দূরত্ব জানতে হবে। যেমন, একটি রেসিং গাড়িকে রেসিং ট্র্যাকের বিন্দু ১ ও বিন্দু ২ দিয়ে অতিক্রম করতে হবে। বিন্দু দুইটির দূরত্ব ধরি ১ মাইল।
গাড়িটি বিন্দু ১ অতিক্রম করতেই ক্রোনোগ্রাফের স্টার্ট বাটনে চাপ দিয়ে কাঁটাটি চালু করতে হবে এবং বিন্দু ২ অতিক্রম করলেই বন্ধ করে দিতে হবে৷ এখানে দেখা যাচ্ছে, বিন্দু ১ থেকে বিন্দু ২ পর্যন্ত যেতে গাড়িটির ৪০ সেকেন্ড লেগেছে। এখন, ৪০ সেকেন্ডের দাগের পাশে ট্যাকিমিটারের মান দেয়া আছে ৯০। অতএব গাড়ির গতিবেগ ছিলো প্রতি ঘন্টায় ৯০ মাইল।

এভাবে ট্যাকিমিটার দিয়ে প্রত্যেক মাইল অতিক্রম করতে ঘন্টায় গাড়ির গতিবেগ কত তা নির্ণয় করা যায়৷ এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মাইলের বদলে যদি কিলোমিটারের হিসাব করা হয়, তবে সেক্ষেত্রে ট্যাকিমিটারটি কাজ করবে কি?
আগামী পর্ব আসা পর্যন্ত ভাবার আহ্বান রইলো…
তথ্যসূত্র- https://www.artofmanliness.com/articles/use-chronograph-tachymeter-wristwatch/
ফিচার ছবি- WatchGeko
0 Comments